চা শিল্পের 'ঐতিহ্য' নামের মশকরা বন্ধ করুন
- Anupam Deb Kanunjna
- Dec 4, 2024
- 7 min read
বাংলাদেশ এবং আয়ারল্যান্ডের নারী ক্রিকেট দলের সিরিজের ট্রফি উন্মোচন করা হয়েছে সিলেটের চা বাগানে। উপমহাদেশের প্রথম চা বাগান এই মালনীছড়ায় আপাতদৃষ্টিতে অসাধারণ এই ফটোসেশন আমাকে বিন্দুমাত্র আকর্ষণ করছে না।

কেন করছে না, সেটা বিস্তারিত বলি।
আমি চা শ্রমিকদের শত বছর ধরে চলমান বঞ্চনার ইতিহাসটা জানি। আপনিও হয়তো জানেন, অথবা অনেকক্ষেত্রে জেনেও এড়িয়ে যান।
'দুই পয়সার শ্রমিকদের' নিয়ে এতো চিন্তা করার চাইতে কোটি কোটি টাকার ক্রিকেট খেলায় চা শিল্পকে 'ঐতিহ্য' হিসাবে তুলে ধরাটা মানসিক শান্তির জন্য ভালো।
তারপরও কয়েকটা তথ্য এবং কয়েকটা সংবাদ শেয়ার করি। কিছু মনে নিবেন না। এক চোখ দিয়ে পড়ে আরেক চোখ দিয়ে বের করে দিতে পারেন। তাতে মানসিক শান্তির ব্যাঘাত ঘটবে না।
২৩ নভেম্বর, ২০২৪ না খেয়ে কত অপেক্ষা করা যায়: চা শ্রমিক ঋষি শিরোনামে বিডিনিউজ সংবাদ প্রকাশ করে রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন ন্যাশনাল টি কোম্পানি নিয়ে। সেখানে বলা হয়েছে,
চা বাগানের ১৭ হাজার শ্রমিকের বেতন তিন মাস ধরে বন্ধ রয়েছে; যাদের ওপর নির্ভশীল অন্তত আরো ৩০ হাজার মানুষ
৩০ নভেম্বর, ২০২৪ বেতন বন্ধে চা শ্রমিকদের মানবেতর জীবন শিরোনামে দৈনিক জনকণ্ঠের প্রকাশিত সংবাদে বলা হয়েছে,
গত বছরও রেকর্ড গড়ে চায়ের উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা ছাড়িয়ে যায় বন্ধ থাকা চা-বাগানগুলোতে। এ বছর উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে ১০ কোটি ৮০ লাখ কেজি। তবে উৎপাদনে ভাটা পাড়ায় এবার লক্ষ্য অর্জন প্রায় অসম্ভব বলে মনে করছে বাগান কর্তৃপক্ষ।
এ তো গেলো কেবল গত মাসের কথা। এবার আসুন দেখি বাংলাদেশে চা শ্রমিকদের বঞ্চনার ইতিহাসটা কতো পুরাতন।
চা শ্রমিকদের জীবন: যৎসামান্য বেতনে বেঁচে থাকার সংগ্রাম শিরোনামে ১০ অক্টোবর, ২০২৪ তারিখে সংবাদ প্রকাশ করে ডয়চে ভেলে। এই সংবাদে চাবাগের শ্রমিকদের বর্তমান দুর্ভোগের পাশাপাশি 'বঞ্চনার ঐতিহ্যও' তুলে ধরা হয়েছে।
একটু কষ্ট করে পড়ুন-
বাগানেই সীমাবদ্ধ শ্রমিকদের জীবন
ভোরবেলাতেই ঘুম থেকে উঠতে হয় চা শ্রমিকদের। একমুঠ মুড়ি আর এক কাপ চা খেয়ে কাজে নেমে পড়েন শ্রমিকরা। কাঠফাটা রোদে দিনভর সংগ্রহ করেন চা পাতা। দুপুরে এক ফাঁকে চা পাতার চাটনি মেখে খান ভাত, কখনো সঙ্গে থাকে মুড়ি কিংবা চানাচুর। এভাবেই কাটে চা শ্রমিকের জীবন। বৃষ্টিতে ভিজে, খালি পায়ে, জোঁক আর বিষাক্ত সাপের সঙ্গে যুদ্ধ করে চা বাগানকে আঁকড়ে জীবন পার করছেন তারা। সবুজ কুঁড়িবেষ্টিত চা বাগানের সীমানাতেই আটকে আছে তাদের জীবন।
বংশ পরম্পরায় যে জমিতে চা শ্রমিকরা বসবাস করেন, সেই জমির ওপর কখনোই মেলে না অধিকার। তাই মাথা গোঁজার আশ্রয়টুকু ধরে রাখতে হলে পরিবারের কাউকে না কাউকে বাগানে কাজ করতেই হয়। দিনশেষে ২৩ কেজি পাতা তুললেই তবে পূরণ হয় মাথাপিছু লক্ষ্যমাত্রা। এই লক্ষ্যমাত্রা পূরণ হলেই তবে ‘হাজিরা' হিসেবে গণ্য করা হয়। গাছ ছাঁটার সময় সারা দিনে অন্তত ২৫০টা চা গাছ ছাঁটতে হয়। কীটনাশক ছিঁটানোর বেলায় সারা দিনে অন্তত ১ একর জমিতে কীটনাশক ছিঁটানোর লক্ষ্যমাত্রার বোঝা কাঁধে নিয়ে কাজ করতে হয় তাদের। প্রত্যেক বছর শ্রমিক দিবস এলে ঘটা করে পালন করা হয় দিনটি। কিন্তু চা বাগানের শ্রমিকরা তাদের জীবনচক্র আটকে ফেলেছেন চা বাগানের গণ্ডির মধ্যেই।
বাংলাদেশ চা শ্রমিক ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক (ভারপ্রাপ্ত) নিপেন পাল ডয়চে ভেলেকে বলেন, "শ্রমিকদের যে সুবিধা দেওয়ার কথা, তার যদি ৮০ ভাগও শ্রমিকরা পেতেন, তাহলে শ্রমিকদের জীবন বদলে যেতো। এখন ৫০ ভাগ সুবিধাও পান না শ্রমিকরা। শ্রমিকদের জীবন বদলে দেওয়ার জন্য আমরা সংগ্রাম করে যাচ্ছি।”
হবিগঞ্জের দেউন্দি চা বাগানের বলরাম সাঁওতাল ডয়চে ভেলেকে বলেন, "পৃথিবীর কোথাও এমন মজুরিতে কাজ করা শ্রমিক আছে বলে মনে হয় না। ঝড়-বৃষ্টি কোনো কিছুকে পাত্তা দেওয়া যাবে না। মাথায় ছই (ছাতা) আর পেছনে ঝাঁকি নিয়ে বাগানে যেতে হবে। কোনো কিছুই আমাদের পেটে ভাত দেবে না, কুঁড়ি তুললেই তবে ভাত জুটবে। বর্তমান বাজারমূল্যের সঙ্গে একজন শ্রমিকের মজুরি হিসাব করলে কোনোভাবেই মেলে না।”
আগে শ্রমিকরা ১২০ টাকা দৈনিক মজুরি পেতেন। ২০২৩ সালের আগস্টে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ‘অনুগ্রহে' তাদের দৈনিক মজুরি ৫০ টাকা বাড়ে। ফলে তাদের দৈনিক মজুরি দাঁড়ায় ১৭০ টাকায়। মজুরি নির্ধারণ নিয়ে যখন চা শ্রমিকদের আন্দোলন তুঙ্গে, তখন বাংলাদেশ টি অ্যাসোসিয়েশনের ১০ সদস্যের প্রতিনিধি দলের সঙ্গে শেখ হাসিনা বৈঠক করেন। প্রায় তিন ঘণ্টা বৈঠকের পর শেখ হাসিনা ৫০ টাকা বাড়ানোর সিদ্ধান্ত দেন।
এর আগে স্থানীয় প্রশাসন ও শ্রম অধিদপ্তরের কর্মকর্তাদের চা শ্রমিক নেতাদের বৈঠকের পর ২৫ টাকা বাড়িয়ে ১৪৫ টাকা দৈনিক মজুরি ঘোষণা করা হয়েছিল। কিন্তু শ্রমিকদের একটি অংশ তাতে ধর্মঘট প্রত্যাহারের ঘোষণা দিলেও বেশিরভাগ শ্রমিক তাতে রাজি হননি। পরে ৫০ টাকা বাড়ানোর সিদ্ধান্ত আসে সাবেক প্রধানমন্ত্রীর কাছ থেকে। সর্বশেষ ২০২০ সালে যখন চা শ্রমিক ইউনিয়ন এবং বাগান মালিকদের সংগঠন চা সংসদ মজুরি নিয়ে চুক্তি করেছিল, সেই সময় মজুরি বাড়িয়ে ৩০০ টাকা করার প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছিল। সে প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়ন হয়নি।
প্রসঙ্গত, ব্রিটিশ ভারতের বাংলাদেশ অংশে প্রথম বাণিজ্যিক-ভিত্তিতে চা চাষ শুরু হয় সিলেটের মালনীছড়া চা বাগানে, ১৮৫৪ সালে। বাংলাদেশ চা উন্নয়ন বোর্ডের তথ্য মতে, দেশে চা বাগান রয়েছে ১৬৭টি। এর বড় অংশটি সিলেট, হবিগঞ্জ এবং মৌলভীবাজার এলাকায় অবস্থিত। এসব বাগানে এক লাখ ৪০ হাজারের মতো শ্রমিক রয়েছে।
যারা নিয়মিত বাজার করেন, দৈনিক মজুরি ১৭০ টাকায় কিভাবে জীবনমান উন্নত করা সম্ভব, আপনারাই বলুন। খেয়েপড়ে বেঁচে থাকার এই চক্র ছেড়ে চা শ্রমিকদের সন্তানেরাও কখনও বের হয়ে আসতে পারছেন না। ফলে প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে চা বাগানের ঐতিহ্যের নামে চালু রয়েছে আধুুনিক এক দাসপ্রথা।
ওপরের ফেসবুক পোস্টটিতে দেয়া সংবাদগুলো একটু দেখে আসি।
১৯ জানুয়ারি, ২০২২ সালে ১৬৮ বছরের ইতিহাসে দেশে সর্বোচ্চ চা উৎপাদন শিরোনামে বিডিনিউজের প্রকাশিত সংবাদে বলা হয়েছে, ২০২১ সালে কোভিড মহামারির মধ্যেই ১৬৮ বছরের চা উৎপাদনের রেকর্ড ছাড়িয়েছে বাংলাদেশের চা বাগানগুলো।
চা বোর্ডের তথ্য অনুসারে, ১৮৫৪ সালে সিলেটের মালনীছড়ায় দেশের প্রথম বাণিজ্যিক চা বাগান প্রতিষ্ঠিত হয়। সেই থেকে ২০১৬ সালে সর্বোচ্চ ৮ কোটি কেজি চা উৎপাদন ছিল সর্বোচ্চ, যা ছাপিয়ে ২০১৯ সালে উৎপাদন ৯ কোটি ৬০ লাখ কেজি হয়।
অথচ, যে বছর চা উৎপাদনের রেকর্ড হয়েছে, সে বছর চা শ্রমিকদের পরিস্থিতি কী ছিল? ২০২১ সালে দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড একটি সংবাদ প্রকাশ করে ১৬৭ বছরে চা শ্রমিকদের দৈনিক মজুরি ১৬৭ টাকাও হয়নি শিরোনামে।
চা শ্রমিক ইউনিয়ন জানায়, ২০১৯ সালের অক্টোবরে মজুরি বোর্ড গঠন করা হয়। ৬ মাসের ভেতর এই বোর্ডের রিপোর্ট করার কথা থাকলেও করোনা বা বিভিন্ন কারণে তা করেনি তারা। বর্তমানে প্রায় আড়াই বছর পর চলতি মাসের ১৩ তারিখ মজুরি বোর্ড তাদের খসড়া প্রকাশ করেছে যেখানে চা শ্রমিকদের দৈনিক মজুরি ১১৭ থেকে ১২০ টাকা নির্ধারণ করেছে। অথচ এই খসড়া প্রকাশের আগে ২০১৯ সালের জানুয়ারী থেকে চা শ্রমিকরা ১১৭ থেকে ১২০ টাকা পাচ্ছে । তাদের দাবি ছিল ৩০০ টাকা দৈনিক মজুরি।
বাংলাদেশ চা শ্রমিক নারী ফোরামের সভাপতি গীতা রানী কানু বলেন, "বিভিন্ন সেক্টরের শ্রমিকদের জন্য দেওয়া সুপারিশগুলোতে ন্যূনতম মজুরি বোর্ড বাৎসরিক হারে পাঁচ শতাংশ বৃদ্ধির সুপারিশ করলেও চা খাতে শ্রমিকদের প্রস্তাবিত ন্যূনতম মজুরি অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি"।
তিনি বলেন, চা খাতে ইনক্রিমেন্ট সিস্টেমের অভাবে একজন অভিজ্ঞ, বছরের পর বছর ধরে কাজ করা চা শ্রমিক এবং নতুন চা শ্রমিকের মজুরি সমান।
মৌলভীবাজার ইউনিটের বাংলাদেশ ট্রেড ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক রজত বিশ্বাস জানান, "মজুরি বোর্ড কর্তৃক প্রকাশিত ৪৩টি শিল্প খাতের মধ্যে চা শ্রমিকদের মজুরি সবচেয়ে কম"।
মালিকপক্ষ থেকে বারবার একটা যুক্তি দেয়া হয়, শ্রমিকদের থাকার ব্যবস্থা, চিকিৎসা, রেশন ইত্যাদি সুযোগ-সুবিধা থাকায় তাদের আসল মাসিক মজুরি নাকি ১২-১৪ হাজার টাকায় দাঁড়াবে।
কিন্তু আসলে কী তাই? চা শ্রমিকদের সন্তানেরা কি চাইলেই বাইরে গিয়ে আমার আপনার সন্তানের মতো স্কুলে পড়ে ডাক্তার-ইঞ্জিনিয়ার বা অন্য কোনো পেশা বেছে নিতে পারবে? দৈনিক ১৭০ টাকা মজুরিতে খাওয়াদাওয়া, পোশাক কেনা এবং দৈনন্দিন অন্য সব খরচ মেটানোর পর সন্তানকে শিক্ষিত করে তোলার মতো অর্থ সঞ্চয়ের ক্ষমতা কতটুকু থাকে, সেটা বোঝার জন্য কি আইনস্টাইন হতে হয়?
৬ নভেম্বর, ২০২৪ তারিখে মৌলভীবাজারের পাত্রখোলা চা বাগান (মাধবপুর লেকের জন্য পর্যটকদের কাছে পরিচিত) নিয়ে একটি সংবাদ প্রকাশ করে বিডিনিউজ।
পাত্রখোলা চা বাগানে বিক্ষোভ: ‘উনুনে বসানোর চাল নেই’ শিরোনামের এই সংবাদের কিছু অংশ তুলে ধরছি।
“সরকারতো একবার এসে আমাদের খোঁজ নিল না।কিছু রেশনের চাল দিলেও তো চলা যেত।”
“সাপ্তাহিক তলবে (বেতন) আমাদের সংসার চলে। চা শ্রমিকদের কোনো সঞ্চয় করার সুযোগ নেই। কয় সপ্তাহ বেতন ছাড়া চলা যায়? প্রায় দুই মাস চলছে বেতন নেই। প্রথম কয়েকদিন দোকান থেকে বাকি নিয়ে খেলেও এখন মিলছে না।”
কথাগুলো বলছিলেন, সরকারের মালিকানাধীন ন্যাশনাল টি কোম্পানির মালিকানাধীন মৌলভীবাজারের কমলগঞ্জে পাত্রখোলা চা বাগানের শ্রমিক অঞ্জুলী ছত্রী।
এই পাত্রখোলা চা বাগানেই সস্ত্রীক ঘুরতে গিয়েছিলাম বছর দুয়েক আগে। সেখানে অলোকা নামে এক চা শ্রমিকের সঙ্গে কথা হয়। পাতা তোলার ফাঁকে একটু জিরানোর পাশাপাশি দুপুরের খাবার প্রস্তুত করছিলেন তিনি। জানেন সে খাবারটা কী ছিল? চা পাতার ভর্তা। খেতে খুব সুস্বাদু বলে সে খাবারা তিনি খাচ্ছিলেন না। এই বেতনে মাছ-মাংস খাওয়াটা তার কাছে বিলাসিতা।
১৭০ টাকার যে দৈনিক মজুরি, সেটাতেও রয়েছে ফাঁকি। দিনে ২৩ কেজি পাতা তুলতে পারলেই শুধুমাত্র তারা ১৭০ টাকা পাবেন, না পারলে তাদের বেতন দেয়া হবে কেজি হিসাবে। ফলে যখন গাছে পাতা কম থাকবে, ১৭০ টাকার ফানুসও বাতাসে উড়ে যায়।
অলোকার সঙ্গে যখন দেখা হয়, তখন আনুমানিক দুপুর ২টা। ততক্ষণে সকাল ৯টা থেকে কাজ করে তিনি কেবল ১০ কেজি পাতা তুলতে পেরেছিলেন। খাওয়ার পর আর কাজ করার সময় রয়েছে দুই ঘণ্টা। এই দুই ঘণ্টায় যে আরো ১৩ কেজি পাতা তোলা যাবে না, সেটা সাধারণ বুদ্ধিতেই বোঝা সম্ভব।
শ্রমিক পরিবারের আরেক সদস্য রাজকুমারের সঙ্গেও কথা হয়েছে। নিজেরাই তাদের কথা শুনতে পারেন এই ভিডিওটিতে।
শ্রমিকদের গল্প তো গেলো। এবার আসুন দেখা যাক, যে চা শিল্পকে ঐতিহ্য হিসাবে তুলে ধরা হয়, সেটির আসলে কী ঐতিহ্য রয়েছে।
দেশের বাইরে থাকার সুবাদে নানা ধরনের চায়ের সঙ্গে পরিচিতি বেড়েছে। আমি ঠিক জানি না, অন্য কারো চোখে কখনও ব্র্যান্ড হিসাবে সিলেট বা শ্রীমঙ্গলের চা নজরে পড়েছে কীনা। আমরা দেশের ভেতরে যতই চায়ের রাজধানী, চায়ের রাজ্য ইত্যাদি নামে আদর করে ডাকি না কেন, দেশের বাইরে কেউ বাংলাদেশের কোনো চা আছে, সেটাই জানে না।
শ্রীলঙ্কার 'সিলন টি', ভারতের 'দার্জিলিং টি', 'আসাম টি' বিশ্বের সকল প্রান্তেই সমাদৃত। এমনকি চীনের চা, তুরস্কের চা, ইন্দোনেশিয়ার চা, কেনিয়ার চা, আর্জেন্টিনার চা সহ বিশ্বের সবচেয়ে বড় চা উৎপাদনকারী দেশগুলোর প্রতিটিরই দেশের বাইরে ব্র্যান্ডিং রয়েছে।
শ্রীলঙ্কার নুয়ারা এলিয়া নামের একটি শহর শ্রীমঙ্গলের মতোই চায়ের জন্য বিখ্যাত। বিদেশ থেকে কেউ শ্রীলঙ্কা ঘুরতে গেলে ট্যুর প্যাকেজে কলম্বো, ক্যান্ডিসহ নানা শহরের পাশাপাশি এই শহরটির নামও থাকে।
নুয়ারা এলিয়ার একটি চা বাগানে আমার বেশ কয়েক বছর আগে যাওয়ার সুযোগ হয়েছিল।
পর্যটকদের চা প্রস্তুত প্রক্রিয়া দেখানোর জন্য দুর্দান্ত আয়োজন রয়েছে সেখানকার প্রায় প্রতিটি বাগানে। প্রতিটি ট্যুরিস্ট গ্রুপের সঙ্গে জুড়ে দেয়া হয় ঐতিহ্যবাহী পোশাকে সজ্জিত এবং ইংরেজি ভাষায় দক্ষ একজন স্থানীয় ব্যক্তিকে। তারা সেখানে চা তোলা থেকে সেটাকে চা পাতায় রূপান্তরিত প্রতিটি প্রক্রিয়া ঘুরিয়ে দেখান। ছবি তোলায় সহযোগিতা করা থেকে শুরু করে সব ধরনের প্রশ্নের উত্তরও দেন এই গাইডরা।
বাগানে রয়েছে চা জাদুঘর এবং সবশেষে চা কেনার ব্যবস্থা।
প্রত্যেক দর্শণার্থীকে বিনামূল্যে এক কাপ করে চা দেয়া হয়। কেউ কেউ ফ্রি চা খেয়েই ভ্রমণ সমাপ্ত করেন, অনেকেই স্যুভেনির হিসাবে থরে থরে সাজিয়ে রাখা নানা ধরনের চায়ের মধ্য থেকে কিছু চা কিনে নিয়ে যান।
এটাকে বলে ব্র্যান্ডিং! বাংলাদেশের চায়ের ব্র্যান্ডিং কোথায়? উপমহাদেশের
চা শিল্পকে ঐতিহ্যের নামে শোষণে রূপান্তরিত না করে এভাবেও বাড়তি আয়ের মাধ্যমে শ্রমিকদের জীবনমানের উন্নয়ন ঘটানো যায়!
একদিকে শ্রমিকদের জীবনমানের দিকে নজর না দিয়ে, অন্যদিকে আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে নিজেদের ব্র্যান্ড তৈরি না করে সবকিছু বড় বড় কোম্পানির হাতে তুলে দেয়াটাকে আর যাই হোক, ঐতিহ্য বলে খুশী হওয়ার কোনো কারণ দেখি না।
ছবিতে দেখা যাচ্ছে স্পন্সর হিসাবে চা বাগানে উঁকিঝুঁকি মারছে সেনিটারি ন্যাপকিনের ব্র্যান্ড সেনোরা। খোঁজ নিয়ে দেখুন একজন নারী চা শ্রমিকও পিরিয়ডের সময় প্যাড কেনার সামর্থ্য রাখেন কীনা।
পারলে 'সিলন টি', 'দার্জিলিং টি', 'আসাম টি' এর মতো 'সিলে টি' ব্র্যান্ড তৈরি করে দেখান। আয়ারল্যান্ডে বসে আইরিশরাও যাতে 'সিলে টি' খেতে পারেন, সেই ব্যবস্থা করুন।
আর শ্রমিকদের এমন একটা জীবন উপহার দিন, যাতে তাদের সন্তানেরাও একদিন জাতীয় দলে ক্রিকেট খেলার স্বপ্ন দেখতে পারে।
আর এইসব না পারলে ঐতিহ্যের নামে এই মশকরা মানসিক প্রশান্তি এনে দিলেও আদতে কোনো কাজে লাগবে না।
Comments